লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : ওমানে ঘুর্ণিঝড় ‘শাহিন’ এ লক্ষ্মীপুরের নিহত তিনজনের পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহ কাছে পাবার আকুতি জানিয়েছেন। প্রবাসে তারা মারা যাওয়ায় একদিকে শোকের ছায়া নেমে এসেছে, অন্যদিকে মৃতদেহ দেশে আনা নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নিহত জিল্লুর রহমানের বৃদ্ধ পিতা লুৎফুর রহমান আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমার ছেলে বিদেশে ছিলো, আল্লাহ নিয়ে গেছে। তাকে তো আর ফিরে পাবো না। কিন্তু মৃতদেহও কি ফিরে পাবো না?
বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছি, আমার ছেলে, ভাতিজা এবং নাতির মৃতদেহ আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দিক। আমরা আন্তত্য যেন নিজ হাতে তাদের কবর দিতে পারি। আমার ছেলের পাঠানো টাকা দিয়ে আমি এবং আমার স্ত্রীর ওষুধ খরচ চলতো। তার চারটি শিশু সন্তান, স্ত্রী। সবাই তার দিকে চেয়ে থাকতাম। এখন আমাদের কি হবে? আমার নাতি নাতনি পুত্রবধূর কি হবে।’ এসব কথা বলে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধ লুৎফর রহমান।
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে নিহত অন্য দুই পরিবারের সদস্যদের মাঝেও। শুধু পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনই নন, এ ঘটনায় পুরো গ্রাম এখন শোকে কাতর।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ অক্টোবর রাতে ওমানে ঘুর্ণিঝড় ‘শাহিন’ এর আঘাতে লক্ষ্মীপুরের একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় তাদের মৃতদেহ খুঁজে পায় তাদের সহকর্মীরা। তাদের মৃতদেহ এখন ওমানের একটি মর্গে রয়েছে।
ওমানে তারা এক বাড়িতে বসবাস করতো। তারা একে অপরকে শ্রমিক ভিসার মাধ্যমে ওমানে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তারা সকলে একই এলাকার বাসিন্দা এবং একে অপরের আত্মীয়। জেলার সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়নের মধ্য মকরধ্বজ গ্রামে তাদের বাড়ি।
নিহতরা হলেন, ওই এলাকার আব্দুল মজিদ চেরাংয়ের বাড়ির মৃত নুরুল আমিনের পুত্র শামছুল ইসলাম (৫০), চাঁন কাজী বাড়ির মো. লুৎফর রহমানের ছেলে জিল্লুর রহমান (৪০) ও হামিদ মিঝি বাড়ির শহিদ উল্যার ছেলে আমজাদ হোসেন হৃদয় (২৫)। এদের মধ্যে শামছুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান আপন চাচাতো-জেঠাতো ভাই এবং আমজাদ হোসেন নিহত শামছুল ইসলামের বোনের ছেলে।
নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তিন প্রবাসী শ্রমিকের আকস্মিক মৃত্যুতে তাদের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনসহ পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তারা সকলে নিহতদের মৃতদেহের অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে তাদের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত প্রশাসন বা স্থানীয় কোন জনপ্রতিনিধি এ বিষয়ে কোন খোঁজ নেননি।
স্থানীয় কামরুল হাসান, মোস্তাফা কামাল, ফরুক, তোফায়েল সহ অনেকে জানান, নিহত তিনজনের মধ্যে দুইজন দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নেই। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তারা। তাদেরকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা এখন শোকে কাতর হয়ে আছে। এরমধ্যে মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা। অন্যদিকে দুই জনের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মৃতদেহ দেশে আনার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগীতা কামনা করেন তারা।
পার্বতীনগর ইউপি চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ওমানে তিনজন নিহত হওয়ার বিষয়টি আমি শুনেছি।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মামুনুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মৃতদেহগুলো দেশে আনার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া তাদের পরিবারের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হবে।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রায় ২০ বছর আগে নিহত শামছুল ইসলাম খেজুর বাগানের শ্রমিক হিসেবে ওমানে যান। এর পর তিনি গত ১১ বছর আগে তার চাচাতো ভাই জিল্লুর রহমানকে খেজুর বাগানের ভিসায় ওমানে নিয়ে যান। সর্বশেষ গত বছরের মার্চ মাসের ১৩ তারিখে ভাগিনা আমজাদ হোসেনকে ‘মাজরা’ ভিসায় সেখানে নেয় শামছুল ইসলাম। ওমানে তারা সকলে স্বল্প বেতনে ভিন্ন ভিন্ন মালিকের খেজুর বাগানে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বসবাস করতেন সাহামে উম্মে ওয়াদি লেবান পারপার নামক স্থানের একটি খেজুর বাগানে থাকা ভবনে।
গত ৩ অক্টোরব ঘুর্ণিঝড় চলাকালীন সময়ে তারা তিনজনই ওই বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। পরদিন থেকে তাদের কোন খোঁজ পাননি পরিবারের সদস্যরা। ওমানে থাকা অন্য প্রতিবেশীদের মাধ্যমে তারা তিনজনের পরিবার ঝড়ে মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারেন।
নিহত আমজাদের পিতা শহিদ উল্যা বলেন, ‘ধারদেনা করে গত বছরের মার্চ আমার ছেলেকে ওমানে পাঠিয়েছি। এখন সে নাই, এ কথা ভাবতেই পারি না। দূর দেশে সে মারা গেছে, আমরা তার লাশটা কি পাবো?’ পরিবারের একমাত্র ছোট ছেলেকে হারিয়ে পুরো পরিবারে শোক নেমে এসেছে। আমজাদের মাতা বিলকিস বেগম ছেলের কথা ভেবে বার বার মূর্চা যাচ্ছেন।
নিহত শামছুল ইসলামের মেয়ে জামাতা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার শ্বশুর এক মাস পর ছুটিতে দেশে আসার কথা ছিলো। এখন সে লাশ হয়ে দেশে আসবে।’